জিলিপির জন্ম পারস্যে, আর আজ তা বাঙালির হৃদয়ে! জানুন কীভাবে এই মিষ্টান্ন পেরিয়ে এসেছে শতাব্দী, ধরেছে নানা রূপ, অমৃতি, খোয়ার জিলিপি, পনিরের জিলিপি ও আরও অনেক কিছু। আবেগ, ইতিহাস ও খাদ্য সংস্কৃতির এক অসামান্য যাত্রা।
“জিলিপি”, এই একটি শব্দেই জড়িয়ে রয়েছে আমাদের শৈশব, উৎসব, রথের মেলা, পাড়ার দোকান আর মনখারাপের মিষ্টি মুহূর্ত। কিন্তু জানেন কি, এই বাঙালির প্রিয় জিলিপির আদি নিবাস কিন্তু বাংলার কোথাও নয়? এই মিষ্টির সাতকাহন খুঁজতে গেলে যেতে হয় পারস্য পর্যন্ত! চলুন, আজ আমরা ডুব দিই জিলিপির অতল রসে...
তেল-চিনির সতর্কবার্তা আর খবরের শিরোনামে জিলিপি!
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার তেল-চিনি নিয়ে স্বাস্থ্য-সতর্কতা জারি করতেই হঠাৎ করে খবরের কাগজের হেডলাইন হয়ে উঠল ‘জিলিপি’ আর ‘শিঙাড়া’। যেমনটা সবসময় হয়, যতই স্বাস্থ্য সচেতনতা আসুক, পেট মোটা হোক কিংবা ব্লাড সুগার বাড়ুক, মেলাতে বা পুজোয় জিলিপি না হলে যেন জমেই না! এই মিষ্টান্ন আমাদের সংস্কৃতির এমন এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, যা শুধুই খাবার নয়, আবেগ, ইতিহাস আর উপমার রসায়ন।
“মানুষের মনের জটিলতা অনেক সময় বোঝানো হয় , ‘জিলিপির মতো প্যাঁচাল।’”
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধানেও মেলে এর নিখুঁত উপমা।
জিলিপির ঘরানা: এক একটি রূপ, এক একটি অঞ্চল
ভারতের প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই জিলিপির নিজস্ব রূপ রয়েছে। অঞ্চলভেদে তার উপকরণ, রং আর স্বাদে এক অপূর্ব বৈচিত্র্য দেখা যায়।
অমৃতি
বাঙালির অত্যন্ত পরিচিত একটি প্রকার, ছোলার ডাল বাটার ব্যাটার দিয়ে তৈরি, গোল আকারের বাইরে বিশেষ কারুকাজ থাকে। এটি রসে ডুবানো হলেও জিলিপির চেয়ে দেখতে আলাদা।
খোয়ার জিলিপি
জব্বলপুরের এই বিশেষতা, খোয়া, দুধ আর বেসন মিশিয়ে তৈরি এই মিষ্টান্ন দেখতে অনেকটা গুলাব জামুনের মতো কালচে-বাদামি।
আলুর জিলিপি
জানলে অবাক হবেন, সেদ্ধ আলু, ময়দা আর চালের গুঁড়ো মিশিয়ে তৈরি হয় এই মিষ্টি। এটি বেশ হালকা ও নরম স্বাদের হয়।
পনিরের জিলিপি
বাঙালির উদ্ভাবনী শক্তির এক অনন্য নিদর্শন, পনির, কর্নফ্লাওয়ার ও ময়দা মিশিয়ে তৈরি হয় এই অসাধারণ স্বাদের জিলিপি।
জিলিপির প্রকৃত জন্মভূমি কোথায়?
“বাঙালির এত আপন জিলিপি, আসলে কিন্তু বাংলার নয়!”
জিলিপির শিকড় খুঁজতে গেলে পৌঁছাতে হয় প্রাচীন পারস্যে। দশম শতকের বিখ্যাত রান্নার বই “কিতাব আল তাবিখ”-এ “জুলবিয়া” নামের এক মিষ্টির উল্লেখ পাওয়া যায়, যার রেসিপি অবিকল আজকের জিলিপির মতো। রমজান মাসে এটি পারস্যে জনপ্রিয় ছিল। ইতিহাসবিদরা বলেন, পারস্য থেকে পর্যটক, বণিক বা মুঘল শাসকদের হাত ধরে ভারতে এসে পৌঁছায় এই মিষ্টান্ন।
“বাংলায় আমরা বলি জিলিপি, উত্তর ভারতে জলেবি, পারস্যে ছিল জুলবিয়া।”
সাহিত্য, প্রবাদ আর উৎসবের মিষ্টি জিলিপি
জিলিপি শুধু খাবার নয়, বাঙালি জীবনের এক কাব্যিক অনুষঙ্গ। ছোটগল্পে, কবিতায়, প্রবাদে, সর্বত্র জিলিপির উল্লেখ মেলে।
- রথের মেলা: শিশুদের হাতে রঙিন বেলুন, আর কাগজে মোড়ানো গরম গরম জিলিপি, এক অমলিন দৃশ্য।
- আড্ডা: কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডায় চায়ের সঙ্গে ছিল জিলিপির চক্রবাক।
- প্রবাদ: “জিলিপির মতো প্যাঁচালে কুলকিনারা পাওয়া দায়।”
এমনকি বাংলাদেশের রাজধানীতে ‘শাহী জিলিপি’ নামে এমন এক রকমের জিলিপি পাওয়া যায়, যার ওজন প্রায় ২ কেজি এবং তাতে ২০টি প্যাঁচ থাকে!
জিলিপি বনাম আধুনিক ডেজার্ট: কে জিতবে আবেগে?
নতুন নতুন মিষ্টি, ফিউশন কেক, চকোলেট মুস, টিরামিসু যতই আসুক না কেন, “গরম গরম জিলিপি”র গন্ধ যেন সমস্ত স্মার্টনেস মুছে দিয়ে শৈশবকে ফিরিয়ে আনে। জিলিপির আবেদনে মায়া আছে, স্মৃতি আছে, আর আছে নিজের মাটির টান।
শেষ কথা: জিলিপির প্যাঁচে বাঁধা এক মিষ্টি প্রেম
জিলিপি শুধুই মুখরোচক নয়, এটি ভারতীয় উপমহাদেশের খাদ্য-ঐতিহ্যর এক মধুর চিহ্ন। পারস্য থেকে শুরু করে আজকের কলকাতা, ঢাকা, দিল্লি বা আমেদাবাদ, জিলিপি হয়ে উঠেছে এক আবেগের নাম। আমাদের জীবনের প্যাঁচালো গল্পগুলোর মতোই, জিলিপিও বারবার ফিরে আসে। আর আমরা বারবার আত্মসমর্পণ করি এই মিষ্টি প্যাঁচের কাছে।
You can also Like: ৪৫০০ বছরের পুরনো মমির কবর ভেবে খোঁড়া হয়েছিল
রামকিঙ্কর বেইজ: বাংলার বিস্মৃত শিল্পীর গল্প
ইথিওপিয়ার মানুষ কি আজও মানুষের রক্ত পান করে?
Jaws’ সিনেমার পর বাস্তবের দুঃস্বপ্ন
.jpg)