শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ—যাঁর জীবনে ছিল দারিদ্র্য, প্রেম, বিদ্রোহ আর কল্পনার তুফান। শান্তিনিকেতনের আড়ালে চাপা পড়া সত্য আজ প্রকাশ পাচ্ছে সাতকাহনে।
খরার দিনে ক্যানভাস ছিল তাঁর চাল – স্মরণে রামকিঙ্কর বেইজ
সাতকাহন ডেস্ক
ছাদের ওপর দিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। ভাঙা চাল থেকে টুপটাপ করে চুঁইয়ে পড়ছে জল। খড় কেনার পয়সা নেই— তাই নিজের আঁকা ক্যানভাস উলটে ঝুলিয়ে রেখেছেন রামকিঙ্কর বেইজ। না, প্রদর্শনী নয়, মাথার ওপরের ছাঁদ ঢাকার জন্য। এমন শিল্পীও ছিলেন আমাদের মাটিতে, যিনি শিল্পকে বেঁচে থেকেও ভিক্ষে করতেন না।
শান্তিনিকেতনের কোণার্ক ভবনের এক বিকেলে, যখন জাফরির ফাঁক গলে রোদ এসে পড়ছিল লাল মেঝেতে, তখন রবীন্দ্রনাথের সামনে হাজির হলেন কিঙ্কর। গুরুজী জিজ্ঞেস করলেন—
“কার মূর্তি গড়েছ কিঙ্কর?”
কিঙ্কর উত্তর দিলেন, “স্বপ্নে এসেছিল... আমি বুঝে গড়িনি।”
এমন কথোপকথন যেখানে শিল্প আর অনুভব একে অপরের সঙ্গে কথা বলে— সেখানেই জন্ম নিত রামকিঙ্করের মতো শিল্পীর সৃষ্টি। কিন্তু শান্তিনিকেতন তাঁকে বুঝতে পারেনি। তাঁকে নিয়ে উঠেছে গুজব, প্রশ্ন হয়েছে তাঁর নারীসঙ্গ, মদ্যপান— অথচ উপেক্ষিত থেকেছে তাঁর গভীর মন, শিল্পে ডুবে থাকা জীবনের স্পন্দন।
নানান মেয়েরা এসেছেন তাঁর জীবনে— কেউ মডেল হয়ে, কেউ ভালোবেসে। খাঁদু, বিনোদিনী, নীলিমা, জয়া, রাধার মতো অনেকেই শুধু শরীর নয়, কিঙ্করের শিল্পে জায়গা করে নিয়েছেন হৃদয়ের অন্তরতমে।
তিনি বলতেন, “সব কিছুর মধ্যেই যৌনতা আছে, যৌনতা ছাড়া সবই ঊষর।” এই সত্য উচ্চারণ করতে দ্বিধা করেননি কখনও। শিল্পের চাহিদায় মডেল হয়ে উঠেছে তাঁর প্রেরণা— কখনও তারা এসেছেন সন্তানের বুক পুষ্টি দিতে দিতে, কখনও একলা দুপুরে দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে।
১৯২৫ সালে বাঁকুড়ার কুমোরপাড়া ছেড়ে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন প্রবাসীর সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে। তখনই কলাভবনে নন্দলাল বসু তাঁকে বলেছিলেন— “তুমি সবই জানো, আবার এখানে কেন?” তবু থেকে যান— ৫৫ বছরেরও বেশি সময়।
ঋত্বিক ঘটক একবার কিঙ্করদাকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানাতে এসেছিলেন। সেই চলচ্চিত্রে দেখা গেল, কিঙ্করদার চালের ওপর ঝুলছে ক্যানভাস। কেন? “খড় কেনার পয়সা নেই... তাই তো!” — এমন সরল হাসির মধ্যে ঢাকা ছিল এক শিল্পীর গৌরবময় দারিদ্র্য।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় এক বিকেলে গিয়ে দেখলেন— অফুরন্ত বাংলা মদ, অফুরন্ত কথা, আর কিঙ্করদার গলায় অফুরন্ত রবীন্দ্রসংগীত— “মোর স্বপনতরীর কে তুই নেয়ে…”
শেষ সময়ে চোখে দেখতে পেতেন না। বলতেন, “চোখ চলছে না, হাত চলছে না… মনে মনে আঁকছি।” আর তাঁর প্রিয় রাধা, যিনি জীবনভর সঙ্গী হয়ে থেকেছেন, তিনিও দেখেছিলেন— কিঙ্করদা যেতে চাইছেন না। শান্তিনিকেতনেই থাকতে চান। কিন্তু তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল কলকাতায়— যেখানেই তাঁর প্রয়াণ।
স্মরণসন্ধ্যায়, মোহর গাইলেন— “ও চাঁদ চোখের জলের লাগল জোয়ার…” কিঙ্করদার জন্য সেই রাত, সেই গান, সেই অশ্রুবিন্দু যেন শিল্পের শেষ প্রণাম।
শেষে শুধু এইটুকু বলা যায়— রামকিঙ্কর ছিলেন না কেবল এক জন শিল্পী, তিনি ছিলেন এক চলমান কানভাস, যাঁর জীবনটুকুই যেন সবচেয়ে বড় ভাস্কর্য।


.jpg)