আশির দশকের কলকাতায় রুনু গুহনিয়োগীর নেতৃত্বে পুলিশের গোপন যুদ্ধ ও গ্যাংস্টার দমন অভিযান, অনীল ঘোষালের সাক্ষাৎকারে এক অনন্য সময়ের গল্প।
পর্ব – ১ :
যখন রাস্তায় হাঁটত আইন, জীবন আর মৃত্যু একসঙ্গে (for part 2 )
সাতকাহন:
আজকের সাতকাহনের এই পর্বে আমাদের অতিথি এক মানুষ, যিনি ছিলেন কলকাতা পুলিশের অ্যান্টি গ্যাং ইউনিটের এক যুগের সাক্ষী। তিন দশকের অভিজ্ঞতায় গড়া এক জীবনের গল্প, যেখানে পুলিশের ব্যাজের পেছনে ছিল রক্ত, ঘাম আর ভয়হীনতা।
তিনি অনীল ঘোষাল, প্রাক্তন ডেপুটি কমিশনার, কলকাতা পুলিশ।
আজ তিনি আমাদের শুনিয়ে দেবেন, সেই সময়ের গল্প, যখন শহরের রাজপথে ঘুরে বেড়াতো গ্যাংস্টাররা, আর তাদের পিছু নিত এক কিংবদন্তি অফিসার রুনু গুহনিয়োগী।
অনীল ঘোষাল:
আমি চাকরিতে ঢুকেছিলাম সম্পূর্ণ কাকতালীয়ভাবে। বাবা চেয়েছিলেন আমি রেলওয়েতে যোগ দিই। কিন্তু ভাগ্য আমাকে টেনে নিল পুলিশের ইউনিফর্মে। ব্যারাকপুর ট্রেনিং কলেজে ছিল আমাদের কঠিন প্রশিক্ষণ। তারপরই খবর এলো, অ্যান্টি-রাউডি সেকশনে নিয়োগ হবে।
তখনকার ডি.সি.ডি.ডি. ছিলেন প্রসূন মুখার্জি (পরে কলকাতা পুলিশের কমিশনার)। উনি ইন্টারভিউ নিয়ে আমাদের পাঁচজনকে বেছে নেন। তখনও জানতাম না, এই নিয়োগই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অধ্যায় হয়ে উঠবে।
সাতকাহন:
তখনকার কাজগুলো কেমন ছিল?
অনীল:
শুরুতে মনে হয়েছিল, এই চাকরি আমার পক্ষে নয়। ইনস্পেক্টর প্রবাস চ্যাটার্জি, যিনি ইংরেজিতে এম.এ, আমার রিপোর্ট দেখে বলতেন, "তুমি তো রিপোর্ট নয়, গল্প লিখছো।” পরে উনি নিজেই বলতেন, “গল্প লিখো, কিন্তু সত্যি লিখো।”“
এরপর এলো আশির দশক। তখন শহর জুড়ে গ্যাংস্টার রাজ। গার্ডেনরিচ থেকে টপসিয়া, প্রতিদিনই কোনও না কোনও গ্যাং সংঘর্ষের খবর। সেই সময়েই রুনু গুহনিয়োগীর নেতৃত্বে তৈরি হয় স্পেশ্যাল সেল। আমরা ছিলাম ওঁর দল।
রুনুবাবু একবার বলেছিলেন, “আইনি কাজ অনেক সময় করতে হয় আইন ভেঙে।” এই এক বাক্যেই ওঁর কর্মদর্শন।
সাতকাহন:
ওঁর নেতৃত্বে কাজ করা কেমন ছিল?
অনীল:
অসাধারণ। ভয়হীন, কিন্তু মানবিক। একটা ঘটনা কখনও ভুলতে পারি না।
আমার বিয়ে ১৯৮৩ সালে। পাইকপাড়ায় অনুষ্ঠান। সেই পাড়ায় আগে যাদের আমরা গ্রেফতার করেছিলাম, তাদের অনেকে মুক্তি পেয়েছে। খবর পেলে বিপদ হতে পারত।
বিয়ের দিন সকালে সহকর্মী এসে বলল, “গুরু, গাড়ি বদলাও, আদেশ এসেছে।” পরে জানতে পারলাম, আদেশটা দিয়েছিলেন রুনু গুহনিয়োগী নিজে।
তিনি চাননি আমি ঝুঁকিতে পড়ি।
একজন অফিসার এমন চিন্তা করতেন তার জুনিয়রদের জন্য, এই মানবিকতাই তাঁকে কিংবদন্তি বানিয়েছে।
সাতকাহন:
তখনকার কলকাতা তো বেশ উত্তপ্ত ছিল, তাই না?
অনীল:
খুব। একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অন্যদিকে অপরাধীদের উত্থান। একরকম গোপন যুদ্ধ চলছিল, পুলিশ বনাম গ্যাং।
আমরা অভিযানে যেতাম, হাতে একটাই রিভলভার, পকেটে সাহস।
আজকের মতো প্রযুক্তি, সিসিটিভি, ট্র্যাকিং কিছুই ছিল না। খবর পেতে হত সোর্সের ওপর নির্ভর করে।
আমাদের সোর্সদের মধ্যে অনেকেই সাবেক অপরাধী ছিল। কেউ কেউ বলত, “পুলিশ-গ্যাং একসাথে চলে।” কিন্তু সত্যি হল, তথ্য পেতে হলে মানুষকে বুঝতে হয়, তার ভেতরের ভয়, স্বার্থ আর মনস্তত্ত্বকে ধরতে হয়। সেটাই ছিল আমাদের গোয়েন্দাগিরির আসল অস্ত্র।
সাতকাহন:
রুনু গুহনিয়োগীর উপর হামলার খবরও শুনেছি...
অনীল:
একাধিকবার।
একবার আততায়ী কাছে এসে বন্দুক তুলেছিল, বুলেট জ্যাম হয়ে যায়।
আরেকবার ওঁর কোয়ার্টারে গ্রেনেড ছোঁড়া হয়েছিল, কিন্তু বিস্ফোরিত হয়নি।
ওঁর গাড়ির পেছনে বোমা ফাটানো হয়েছিল, কিন্তু ওঁর গায়ে আঁচড়ও লাগেনি।
মনে হতো, ভাগ্য যেন নিজেই তাঁকে রক্ষা করছে।
you can also read: জিলিপির সাতকাহন
you can also read: ৪৫০০ বছরের পুরনো মমির কবর ভেবে খোঁড়া হয়েছিল!
পরবর্তী পর্বে পড়ুন:
- কলকাতার গ্যাংস্টার রাজের ভিতর থেকে উঠে আসা অদ্ভুত সব চরিত্রের গল্প, হেমেন মণ্ডল, তুষার হালদার, সাহেব শঙ্কর, আর এক অদ্ভুত “রবিনহুড”।
- জানুন, কীভাবে রুনু গুহনিয়োগী আর তাঁর টিম তৈরি করেছিল কলকাতার আন্ডারওয়ার্ল্ড-বিরোধী ইতিহাস।


