বিশ্বকে কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছিল ওমায়রা , দিয়ে গিয়েছিল ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ছবিটি
ওমায়রা স্যাঞ্চেজ – ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক আলোকচিত্র

কলম্বিয়ার আর্মেরো বিপর্যয়ের সময় ১৩ বছরের ওমায়রা স্যাঞ্চেজ ৬০ ঘণ্টা কাদায় দাঁড়িয়ে লড়েছিল মৃত্যুর সঙ্গে। সাতকাহনের বিশেষ প্রতিবেদন।
Satkahon | Special Feature
ভূমিকা
১৯৮৫ সালের ১৩ নভেম্বর। কলম্বিয়ার ছোট্ট শহর আর্মেরো। সকাল থেকেই আকাশ ভারি, বৃষ্টি আসছিল থেমে থেমে। তেরো বছরের ফুটফুটে মেয়ে ওমায়রা স্যাঞ্চেজ ধান তুলছিল বাবার সঙ্গে। মা মারিয়া তখন রাজধানী বোগোটায় নার্স হিসেবে কর্মরত।
সন্ধ্যার পরপরই পৃথিবী সাক্ষী হয়েছিল এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডির , যে ঘটনার সাক্ষী হয়ে জন্ম নিয়েছিল ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক আলোকচিত্র, আর এক মেয়ের অদম্য লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে বেঁচে গিয়েছিল ওমায়রা স্যাঞ্চেজ নামটি।
“ঘুমন্ত সিংহের জাগরণ”
ওমায়রা ভেবেছিল মেঘ ডাকছে। কিন্তু সেই গুমগুম শব্দ ছিল ৭৯ বছর পর জেগে ওঠা নেভাডো ডেল রুইজ আগ্নেয়গিরির গর্জন।
অক্টোবরে কলম্বিয়ান ভূতত্ত্ব দফতর সতর্ক করেছিল, সবচেয়ে বিপর্যস্ত হবে আর্মেরো শহর। কিন্তু সরকার কর্ণপাত করেনি।
১৩ নভেম্বর রাত ৯টা ৯ মিনিটে বিস্ফোরিত হয় আগ্নেয়গিরি। লাভার উত্তাপে গলে যায় বরফ, তৈরি হয় মৃত্যুর জলোচ্ছ্বাস। ২২ কিমি গতিতে ধেয়ে আসে তিনটি কাদা ও শিলার ঢেউ। প্রথম ঢেউ সরাসরি আঘাত করে আর্মেরো শহরে।
মৃত্যুপুরীতে ওমায়রা
অন্ধকারে টর্চ হাতে ছাদে উঠে পড়েছিল ওমায়রা, বাবা, ভাই ও কাকিমা।
হঠাৎ সব টর্চ নিভে যায়। তারপরই ধেয়ে আসে কাদা ও গাছের গুঁড়ি মিশ্রিত ভয়াবহ ঢেউ।
ভেসে যায় ওমায়রার বাবা ও ভাই। ভেঙে পড়া বিমে আটকে যায় ওমায়রা ও কাকিমা।
কাদার নিচে তলিয়ে যেতে যেতে কাকিমা শেষবারের মতো আঁকড়ে ধরেছিলেন ওমায়রার পা।
ওমায়রার জ্ঞান ফেরে বৃষ্টির ছাটে। দেখে, সে গলা অবধি কাদায় ডুবে আছে। চারপাশে মৃত্যু, নিস্তব্ধতা, আর কান্নার আওয়াজ।
পঁচিশ হাজার প্রাণ নিথর হয়ে পড়ে থাকে আর্মেরোর বুকে।
ওমায়রা চিৎকার করছিল, “ও বাবা তুমি কোথায়?”, “ভাইরে তুই কই?”, “আমাকে বাঁচাও কাকিমা!”
জল ধীরে ধীরে উঠে আসে তার ঠোঁট পর্যন্ত, কিন্তু সে ডান হাত দিয়ে কাদা আঁকড়ে রাখে রাতভর।
আশার আলো
১৪ নভেম্বর সকালে পৌঁছায় রেড ক্রস ও স্থানীয় উদ্ধারকারী দল। মৃতদের স্তুপের মধ্যে থেকে ভেসে আসে কণ্ঠ, “আমাকে বাঁচাও!”
চমকে ওঠে উদ্ধারকারীরা। খুঁজে পায় জীবিত ওমায়রাকে। কিন্তু তার পা কংক্রিট ও বিমে চেপে রয়েছে।
সারাদিন চেষ্টা চলে, মুক্ত হয় শুধু কোমর আর হাত।
প্রতিবার জঞ্জাল সরাতেই কাদা ভরে যায়। তাকে ভাসিয়ে রাখার জন্য পরানো হয় টিউব, হাতে ধরা হয় একটি ডাল।
১৫ নভেম্বর ডুবুরি নামে জলে। আবিষ্কার হয় ভয়াবহ দৃশ্য, ওমায়রার পা চেপে রয়েছে কংক্রিটের বিমে, আর তার ওপর পড়ে আছেন এক মৃতা মহিলা, কাকিমা আলেইডা।
উদ্ধারকারীরা গ্যাসকাটার, পাম্প, বুলডোজার চায় সরকারের কাছে।
কিন্তু সেই সময়ে কলম্বিয়ার সেনা গেরিলাদের দমন অভিযানে ব্যস্ত, তাই সাহায্য আসে না।
সরকারের নিষ্ঠুরতা চূড়ান্ত রূপ নেয়।
মৃত্যুপরোয়ানায় সই
রেডক্রসের চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নেন, অপারেশন করে পা কেটে ফেলতে হবে।
কিন্তু জলের নিচে তা অসম্ভব। গ্যাংগ্রিনে মৃত্যু অনিবার্য।
তাই সিদ্ধান্ত, “ওমায়রাকে মরতে দাও।”
এই নির্মম পরোয়ানায় সাক্ষর হয়ে যায় এক তেরো বছরের বালিকার ভাগ্যে।
ওমায়রা ও সাংবাদিক মারিয়া
সেই সময় তার পাশে ছিলেন কলম্বিয়ান সাংবাদিক সান্টা মারিয়া বাররাগান।
ওমায়রার চোখে অদম্য বাঁচার ইচ্ছা। সে গল্প করত, গান গাইত, “সূর্য ওঠার গান, সবুজ মাঠের গান।”
শেষ ইচ্ছায় চেয়েছিল মিষ্টি আর সফট ড্রিঙ্কস, মারিয়া তা এনে দিয়েছিলেন।
এই কথোপকথনের মধ্যেই ওমায়রার সাক্ষাৎকার নেয়া হয়, যা পৃথিবীকে জানায় সেই ভয়ঙ্কর রাতের ইতিহাস।
“দ্য গার্ল ইন দ্য রাবল”, এক ছবির জন্ম
ফরাসি ফটোসাংবাদিক ফ্র্যাঙ্ক ফোর্নিয়ার পৌঁছেছিলেন আর্মেরোতে ১৫ নভেম্বর রাতে।
তিনি ক্যামেরায় বন্দি করেন ওমায়রার লড়াই,
অন্ধকারে আলোকিত টর্চের আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা এক মেয়ের মুখ, যে জীবনের জন্য লড়ছে।
সেদিন রাত থেকে ওমায়রা অসংলগ্নভাবে বলছিল,
“দু’দিন আমি স্কুলে যাইনি… আমায় স্কুলে দিয়ে এসো… না হলে অঙ্ক পরীক্ষা দিতে পারব না…”
মারিয়া দূরে সরে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন।
শেষ সকাল
১৬ নভেম্বর সকাল। ওমায়রার শরীর ঠান্ডা, ঠোঁট নীলচে, চোখে জমে রক্ত।
তবুও সে হাত বাড়ায়, যেন বলে, “শেষবারের মতো আমায় টেনে তোলো।”
ক্যামেরায় সেই মুহূর্তগুলো ধরে রাখেন ফোর্নিয়ার।
সকাল ১০টা ৫ মিনিট। ওমায়রার মাথা ধীরে ধীরে হেলে পড়ে জলের মধ্যে।
শেষ হয় ষাট ঘণ্টার যুদ্ধ। নীল-সাদা চাদরে ঢেকে দেওয়া হয় ওমায়রার নিথর শরীর।
বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ
ফোর্নিয়ারের তোলা সেই ছবি, “Omayra Sánchez – The Girl Who Shook the World”
দেখে কেঁপে ওঠে মানবতা। কলম্বিয়ার রাস্তায় লক্ষ মানুষ নেমে আসে পোস্টার হাতে
“আগ্নেয়গিরি নয়, ২৫,০০০ প্রাণ কেড়ে নিয়েছে অপদার্থ সরকার।”
মৃত্যুর পরের জীবিত ওমায়রা
৩৭ বছর কেটে গেছে। আর্মেরো শহর আজও নিস্তব্ধ।
তবুও স্থানীয়রা বলে, সন্ধে নামলেই ভেসে আসে এক কণ্ঠ, “আমাকে বাঁচাও, আমি তলিয়ে যাচ্ছি…”
২০২০ সালে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন এক নতুন প্রজাতির ঝিঁঝিপোকা, যার নাম দেন ,
“Gigagryllus Omayrae”।
ওমায়রাকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখার এক প্রতীক যেন।
ওমায়রা আজও আর্মেরোর বাতাসে ভেসে থাকে ,
এক মেয়ে, যে মৃত্যুর মধ্যেও জীবনকে ভালোবেসেছিল।
Tags
Article

