‘সাকার ফিশ’: কাচের ঘরের শোভা থেকে জলাশয়ের মৃত্যুদূত!
invasive sucker fish in Indian rivers destroying biodiversity

লেখা: প্রলয় চ্যাটার্জী | সাতকাহন
জলের তলায় সে নিঃশব্দে চলে। দেখতে শান্ত, কিন্তু তার উপস্থিতিতেই থেমে যাচ্ছে নদীর শ্বাস, বিলের প্রাণ। হ্যাঁ, এই নীরব ঘাতকের নাম, সাকার ফিশ।
যতক্ষণ সে কাচের অ্যাকুয়ারিয়ামে বন্দি, ততক্ষণ সব ঠিকঠাক। কিন্তু একবার মুক্তি পেলেই, সে হয়ে ওঠে আমাদের নদী-খাল-বিলের অদৃশ্য মৃত্যুদূত।
এক বিদেশি অতিথির আগমন
কখনও একসময় আমাদের নদী-খালগুলো ছিল দেশীয় মাছের স্বর্গ। চ্যাং, কই, শিঙি, টেংরা, জল কাঁপত তাদের প্রাণোচ্ছ্বল দৌড়ে। কিন্তু আজ সেই জলে নেমেছে এক নীরব দখলদার। দক্ষিণ আমেরিকার গভীর নদী থেকে এসেছে Pterygoplichthys spp., যাকে আমরা বলি সাকার ফিশ, কেউ কেউ কমন প্লেকো, আর বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে তাকে বলে রোহিঙ্গা মাছ। চওড়া মাথা, পাথরের মতো শক্ত আঁশ, দেখতে যেন ছোট্ট কুমির! তাই অনেকে আবার একে ক্রোকোডাইল ফিশ নামেও চেনে।
অ্যাকুয়ারিয়ামের তারকা থেকে প্রকৃতির আতঙ্ক
অ্যাকুয়ারিয়ামের কাচ পরিষ্কার রাখে বলে অনেকেই শখ করে একে ঘরে নিয়ে আসেন।
কিন্তু সমস্যা শুরু হয় যখন ছোট্ট অ্যাকুয়ারিয়ামের বাসিন্দা একদিন হয়ে ওঠে দৈত্যাকার। জায়গা না থাকলে কেউ কেউ দয়া করে একে ছেড়ে দেন পাশের পুকুরে, খালে বা নদীতে। আর তখনই শুরু হয় এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়,
এক বিদেশি মাছের হাতে দেশীয় জীববৈচিত্র্যের ধ্বংসযজ্ঞ।
কেন এত বিপজ্জনক এই মাছ?
সাকার ফিশের জীবনযাত্রা অন্যরকম। অক্সিজেন কম, দূষিত, কাদাযুক্ত জল, তাতে দিব্যি বেঁচে থাকে।
খাবারের বেলায় কোনো বাছবিচার নেই, পচা শৈবাল, মৃত প্রাণী, মাছের ডিম, এমনকি ছোট মাছও তার খাদ্য।এই সর্বভুক প্রকৃতি তাকে করে তুলেছে অপ্রতিরোধ্য।
আর সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো এর প্রজনন ক্ষমতা।
একটি স্ত্রী মাছ একবারে ১৫০-২০০টি ডিম পাড়ে, পুরুষ মাছ সেগুলির পাহারা দেয়।
বছরে একাধিকবার এভাবে ডিম দেয় তারা, ফলে কয়েক মাসেই সংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটে।
এদের খোঁড়া গর্তে নদীর তলদেশ ভেঙে পড়ে, জলের স্বচ্ছতা নষ্ট হয়, দেশীয় মাছের প্রজনন বন্ধ হয়ে যায়।ফল, আমাদের পরিচিত মাছগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে।
অর্থনৈতিক ক্ষতি আর প্রাকৃতিক বিপর্যয়
জেলেদের জালে এখন প্রায়ই ধরা পড়ে এই মাছ। কিন্তু বিক্রি হয় না।
উল্টে তাদের শক্ত আঁশে ছিঁড়ে যায় দামি জাল। প্রতিটি ধরা পড়া মাছ যেন এক টুকরো লোকসান, আর নদীর বুক থেকে এক টুকরো প্রাণ চলে যাওয়ার প্রতীক।
দক্ষিণ আমেরিকায় কেন নয় এই বিপর্যয়?
কারণ ওখানে প্রকৃতি নিজের ভারসাম্য রক্ষা করতে জানে।
ওখানে আছে পিরানহা, আরাপাইমা, বড় ক্যাটফিশ, এমনকি কুমির, যারা সাকার ফিশের প্রাকৃতিক শত্রু। কিন্তু ভারতে নেই সেই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। এখানে নেই কোনো শিকারি, নেই কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী, ফলে নদীগুলির বুকজুড়ে এখন শুধু এক শাসক,
সাকার ফিশ!
সমাধান এখনই জরুরি
🔹 অ্যাকুয়ারিয়ামের মাছ কখনোই স্থানীয় জলাশয়ে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়।
🔹 সরকার ও পরিবেশ সংস্থার উচিত জলাশয়গুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা।
🔹 স্কুল-কলেজে পরিবেশ শিক্ষায় এই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
কারণ, এই মাছের শান্ত মুখের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়ঙ্কর সত্য, একদিন হয়তো আমাদের প্রিয় দেশীয় মাছগুলো শুধু ছবিতে দেখা যাবে, গল্পে শোনা যাবে।
শেষ কথা
জলজ জীবন মানে শুধু মাছ নয়, এক জীবন্ত প্রতিবেশ।
সাকার ফিশ সেই প্রতিবেশের নিঃশব্দ ঘাতক।
তাই এখনই সময়, মানুষকে জানাতে, সব বিদেশি সুন্দর জিনিসই আমাদের জন্য নিরাপদ নয়।
You can also read: কলকাতার আন্ডারওয়ার্ল্ড আর এক কিংবদন্তির ছায়া
You can also read: অনীল ঘোষালের সাক্ষাৎকারে এক অনন্য সময়ের গল্প।
You can also read: ইতিহাস ও খাদ্য সংস্কৃতির এক অসামান্য যাত্রা।
.jpg)
