ইথিওপিয়ার মানুষ কি আজও মানুষের রক্ত পান করে? একটি বিভ্রান্তির চূড়ান্ত বিশ্লেষণ

ইথিওপিয়ার উপজাতিরা মানুষের রক্ত পান করে এই ধারণার ভিত্তি কতটা সত্য? গরুর রক্ত খাওয়ার সংস্কৃতি ও ভুল তথ্যের পার্থক্য বিশ্লেষণ করুন এই গভীর অনুসন্ধানে।

ইথিওপিয়ার মানুষ কি এখনও মানুষের রক্ত পান করে? 

আজকের আধুনিক সভ্যতার যুগেও আফ্রিকার কয়েকটি অঞ্চলের আদিবাসী সমাজ নিয়ে নানা কল্পনা, গুজব ও বিভ্রান্তি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে আছে। তাদের জীবনযাত্রা, পোশাক, আচার-অনুষ্ঠান কিংবা খাদ্যাভ্যাস ঘিরে তৈরি হয়েছে বহু অর্ধসত্য ও রোমাঞ্চপ্রবণ গল্প। এমনই একটি বহুল প্রচারিত ও ভুল ধারণা হল “ইথিওপিয়ার কিছু উপজাতি নাকি এখনও মানুষের রক্ত পান করে।”

Ethiopia Omo Tribal 

এই দাবির ভিত্তিতে ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ইথিওপিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের ওমো উপত্যকায় সরেজমিনে পৌঁছে তথ্য অনুসন্ধান করেন চ্যানেল ইলেভেন-এর প্রতিনিধি। সেখানে সুরমা, হামার, করো এবং বেনা উপজাতিদের সঙ্গে কাটানো কয়েকদিনের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ আলোকপাত করে এই বিভ্রান্তির আসল চেহারায়।

গরুর রক্ত পান: প্রথা, খাদ্য ও টিকে থাকার কৌশল

ওমো উপত্যকার জনজাতিগুলির মধ্যে গরুর রক্ত পান একটি পরিচিত ও প্রাচীন চর্চা। মূলত গরুর ঘাড়ে একটি ছোট ছিদ্র করে সতর্কতার সঙ্গে সামান্য পরিমাণ রক্ত সংগ্রহ করা হয়। এই রক্ত গরম অবস্থায় দুধের সঙ্গে মিশিয়ে পান করা হয়। বিশেষ করে খরা, দারিদ্র্য বা দীর্ঘ পথচলার সময় এটি তাদের প্রোটিন, লবণ এবং শক্তির গুরুত্বপূর্ণ উৎস। অনেক সময় রোগী বা দুর্বল ব্যক্তিকেও এই পানীয় দেওয়া হয় পুনরুজ্জীবনের উদ্দেশ্যে।

Wedding Dress

এই প্রথাটি যে নৃশংস, বর্বর কিংবা অমানবিক, এমনটা বলার কোনও সুযোগ নেই। গরুকে হত্যা না করেই এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এবং পরবর্তী দিনগুলিতে ওই গরু পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায়। এটি একধরনের সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত, যেখানে প্রাণী সম্পদের সদ্ব্যবহার হয় অত্যন্ত মানবিক উপায়ে।

“মানুষের রক্ত পান”  গুজবের উৎপত্তি কোথায়?

প্রতিনিধির অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, মানুষের রক্ত পান করার কোনও প্রথা বা সংস্কৃতি ওমো উপত্যকার উপজাতিদের মধ্যে নেই। তাহলে এই গুজবের উৎস কী?

Tribal culture.

বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে উপজাতিদের ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে মুখে লাল রঙ, কাদামাটির অলংকার বা গরুর রক্ত মাখা মুখ দেখা যায়। এসব ছবি দেখে অনেকেই ভুলভাবে ধরে নেন, তা “মানুষের রক্ত”। এছাড়া কিছু ইউটিউব ব্লগ বা পর্যটন সংক্রান্ত ভ্লগে "ভয়ঙ্কর উপজাতি" বা "রক্তপায়ী সমাজ" শিরোনামে ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে যা সম্পূর্ণরূপে অপবৈজ্ঞানিক ও বিভ্রান্তিকর।

এমনকি পশ্চিমা পর্যটকদের তৈরি কিছু ভুয়ো তথ্যনির্ভর চিত্রনাট্যও দীর্ঘদিন ধরে উপজাতিদের সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়াতে সাহায্য করেছে।

বাস্তবতা অনেকটাই আলাদা

ইথিওপিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের এই উপজাতি সমাজ মূলত কৃষিনির্ভর, পশুপালননির্ভর এবং গভীরভাবে প্রাকৃতিক জীবনধারার অনুসারী। অতিথিপরায়ণতা, সম্প্রদায়ের প্রতি দায়িত্ববোধ এবং পরিবেশের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই তাদের জীবনের মূল সুর।

Tribal culture.

তাদের মধ্যে কোনও ধরনের বর্বরতা, হিংস্রতা কিংবা মানুষের রক্ত খাওয়ার মতো কাজ বর্তমানে দেখা যায় না। বরং, তারা আধুনিক জীবনধারার অনেক কৃত্রিমতা থেকে দূরে থেকে প্রকৃতির ছায়ায় নিজেদের সংস্কৃতি টিকিয়ে রেখেছে।

উপসংহার

ইথিওপিয়ার উপজাতিদের “মানুষের রক্ত পান” করার ধারণাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং গুজব নির্ভর।
গরুর রক্ত পান একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যা টিকে থাকার কৌশল ও প্রোটিন চাহিদা পূরণের জন্য ব্যবহার হয় বহু বছর ধরে।

Mursi woman dressed up for the Donga

একে “মানুষ খাওয়া” বা “রক্তপায়ী বর্বরতা” বলে দেগে দেওয়া একধরনের সাংস্কৃতিক বৈষম্য এবং অজ্ঞতার পরিচয়।
আফ্রিকার গহীনে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে মিশলে বোঝা যায় এই সমাজের গভীরে আছে এক ধরনের সরলতা, সৌন্দর্য এবং সভ্যতা, যা আধুনিকতার আলো-ছায়ার বাইরে থেকেও মানবিকতায় সমৃদ্ধ।

Read More: হাঙরের বিপন্ন ভবিষ্যৎ

                      ওয়াইনের ছোঁয়ায় বাঙালি রান্নার নতুন জাদু

                       ভারতের প্রথম নাট্যশালার শহর 

                        নর মুন্ডু শিকারির দেশে

                         মানুষের চামড়া দিয়ে বানানো চেয়ার-ল্যাম্প


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন