২০১৪ সালে আমি গিয়েছিলাম নাগাল্যান্ডের এক প্রত্যন্ত কোণে—কনিয়াক উপজাতিদের গ্রামে। যারা একসময় মানুষের মুন্ডু শিকার করত, সেই 'শেষ হেডহান্টার'দের দেশ এখন ইতিহাস আর সংস্কৃতির জীবন্ত জাদুঘর। এ এক বাস্তব গল্প, যা ভয়, বিস্ময় আর ঐতিহ্যের মিশেল।
নর মুন্ডু শিকারির দেশে
প্রলয় চট্টোপাধ্যায় | স্মৃতিচারণ | নাগাল্যান্ড, লংওয়া | সফরের সাল: ২০১৪
একটি বিস্ময়কর, রোমাঞ্চকর ভ্রমণকাহিনি
২০১৪ সালের এপ্রিল মাস। পশ্চিম বাংলার অস্থির শহরজীবন থেকে ছুটি নিয়ে আমি পাড়ি জমালাম উত্তর-পূর্ব ভারতের সেই মাটিতে, যেখানে পাহাড়-জঙ্গলের মাঝে বাস করে এক সময়ের কুখ্যাত কোনিয়াক উপজাতি। একসময় এদের নাম শুনলেই কেঁপে উঠত পাশের গ্রামগুলো। কারণ? এরা ছিল ‘হেডহান্টার’—মানুষ শিকার করে কেটে মাথা নিয়ে আসত। এক আধুনিক সাংবাদিক হিসেবে, আমি জানতাম এটা ইতিহাস, কিন্তু সেই ইতিহাসের ধুলো মোছার সাহস ছিল আমার মধ্যে। সাংবাদিক জীবনে বহু জায়গায় ঘুরেছি, কিন্তু এ যেন এক অন্যরকম টান। এক সন্ধ্যায় গুজরাটে কাজ করতে করতে হঠাৎ পড়ে গেলাম এক পুরনো ব্রিটিশ নথিতে নাগাল্যান্ডের এক উপজাতির কথা, যারা এক সময় মানুষের মাথা শিকার করত।
কাগজে লেখা ছিল ‘Headhunters of Nagaland’। বইয়ের পাতায় পড়েছিলাম, কিন্তু জানতাম না এই রক্তমাখা ইতিহাস এতটা জীবন্তভাবে টিকে আছে আজও। সিদ্ধান্ত নিলাম—চোখে দেখা না পর্যন্ত বিশ্বাস করব না।
আমার সফর শুরু হয় ডিমাপুর থেকে। সেখান থেকে বাস ও গাড়ি বদলাতে বদলাতে পৌঁছলাম নাগাল্যান্ডের একেবারে উত্তরের জেলা—মোন। এখানেই বাস কনিয়াক উপজাতির, যাঁরা একসময় গোত্র যুদ্ধের সময় শত্রুদের মুন্ডু কেটে আনতেন এবং তা ঘরে রেখে দিতেন।
এই মুন্ডু ছিল গর্বের, সাহসের ও শ্রেষ্ঠত্বের চিহ্ন। মুন্ডুর সংখ্যা দেখে ঠিক হত—কে কত বড় যোদ্ধা। সবচেয়ে অবাক করা তথ্য—এই প্রথা বন্ধ হয় মাত্র ৫০–৬০ বছর আগে, ১৯৬০-এর দশকে। কোহিমা হয়ে যখন আমি মোন জেলায় পৌঁছালাম, তখন চারদিক ঘন কুয়াশায় মোড়া। রাস্তার দু’পাশে বাঁশবনের সারি, দূরে পাথরে খোদাই করা মুখ—যেন কেউ সতর্ক করে দিচ্ছে, “সাবধান, তুমি ঢুকছ ইতিহাসের সেই অধ্যায়ে, যেখানে রক্ত এখনও শুকিয়ে যায়নি।”
কোনিয়াক গ্রাম – যেখানে সময় থেমে গেছে
মোন জেলার এক প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে পৌঁছে দেখি, জীবনের ছন্দ একেবারেই ভিন্ন। কাঠ ও বাঁশে তৈরি ঘরগুলোয় কালো ধোঁয়ার গন্ধ, শিশুদের চোখে কৌতূহল আর বয়স্কদের মুখে অদ্ভুত নির্লিপ্তি।
আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের এক প্রবীণ নেতা টংচু এর কাছে, যার মুখে বিশাল উল্কি—ভ্রুর উপর কালো রেখা, গালে ত্রিভুজ আঁকা, কপালে গাঁথা পাথরের দানা। তিনি ছিলেন এক সময়ের প্রকৃত শিকারি, যার হাতে কাটা পড়েছে বহু শত্রুর মাথা। এটা ভারতের একমাত্র এমন গ্রাম, যেখানে একটা বাড়ি দুই দেশে—ভারত ও মায়ানমার—বিস্তৃত। গ্রামের রাজা (Chief Angh) নিজে থাকেন সেই বাড়িতে।
রাজাকে যখন সাক্ষাৎ করি, উনি হেসে বলেছিলেন:
“আমি খাই ভারতে, আর ঘুমাই মায়ানমারে। কিন্তু আমি কনিয়াক, দেশের সীমানা আমাদের ভাগ করতে পারে না।”
তিনি চুপচাপ বসে ছিলেন আগুন জ্বলা চুলার পাশে। আমি তাঁকে প্রণাম জানিয়ে বসতেই বললেন,
“তুমি কলকাতা থেকে এসেছ? তোমাদের শহরে কি এখনো লোকের মুখ কাটা হয় না কথার ছুরিতে?”
আমি হেসে উঠলাম। কিন্তু তখনও জানতাম না, এই মানুষটার ভেতর কত ইতিহাস চাপা পড়ে আছে।
রাজবাড়ির কাছেই বসে ছিলেন কয়েকজন বয়স্ক কনিয়াক পুরুষ। তাঁদের গালে গভীর উল্কি, নাকে নাকছাবি, কপালে কাঠের চিহ্ন। বয়স ৭৫-৮০ ছুঁই ছুঁই। আমি পাশে গিয়ে বসলাম।
জিজ্ঞাসা করলাম—“আপনি কি কখনো মুন্ডু এনেছিলেন?”
এক বৃদ্ধ ধীরে মাথা নাড়লেন। তাঁর চোখে জল চলে এল। বললেন—
“হ্যাঁ, এনেছিলাম। তখন আমরা জানতাম না যে সেটা ভুল। শত্রু ছিল আমাদের জন্য অভিশাপ। মুন্ডু আনলে উৎসব হত, আজ আর সেই উৎসব হয় না।”
বুঝলাম—একটা গোত্রের বিবর্তন কীভাবে রক্ত থেকে মানবিকতায় রূপ নেয়।
‘শিকার’—কেবল রক্ত নয়, ছিল এক ধরনের জীবনদর্শন
টংচু জানালেন, “আমাদের পুরুষদের বীরত্ব বিচার হতো কতগুলো মাথা কেটেছি তার ওপর। শত্রু উপজাতির পুরুষদের হত্যা করে, মাথা এনে ‘মোরুং’-এ ঝুলিয়ে রাখা হতো। মাথা যত বেশি, সমাজে তত সম্মান।”
আমি কাঁপা কাঁপা হাতে উঠে গেলাম সেই মোরুং-এ—একটা বিশাল বাঁশের কাঠামো, যার ছাদে ঝোলানো বহু পুরোনো খুলি। কেউ কেউ ফাটল ধরা, কিছু মাথায় আঁকা ট্যাটু। কেউ কেউ এখনো যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে!
এক বৃদ্ধা মহিলা, যিনি হালকা ছাই রঙা শাড়িতে চুলে মাদুলি পরে বসেছিলেন, বললেন,
“আমি বিয়ে করতে পেরেছিলাম কারণ আমার স্বামী তিনটে শত্রুর মাথা এনেছিল। ওই মাথার জন্যেই আমরা জমি পেয়েছিলাম।”
আগে যাঁরা মুন্ডু শিকার করতেন, তাঁদের গালে এক বিশেষ ট্যাটু করা হতো। এই উল্কি তাঁরা পেতেন যুদ্ধে জেতার পর। এখন তা দেখা যায় শুধুমাত্র বয়স্কদের মুখে।
তাঁদের বাড়ির ভেতরেই ঝুলে আছে কাঠের খুলি, পশুর দাঁতের মালা, পুরনো তীর-ধনুক ও বন্দুক। পুরনো দিনের অস্ত্র এখন স্যুভেনির হলেও, স্মৃতি কিন্তু অমলিন।
ভয়াবহ ইতিহাসের শেষ অধ্যায়?
২০০১ সালে ভারত সরকার ও উপজাতিদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে ‘হেডহান্টিং’ নিষিদ্ধ করা হয়। এখন তারা নিজেদের সাংস্কৃতিক উৎসব, কাঠের হস্তশিল্প আর রঙিন উৎসবের মাধ্যমে নিজেদের প্রাচীনতা রক্ষা করছে।
তবে বিশ্বাস করুন, ওই মোরুং-এর ভিতর দাঁড়িয়ে আমার মনে হচ্ছিল, এই নিষেধাজ্ঞা যেন সময়কে বেঁধে রাখতে পারেনি। প্রজন্ম পাল্টেছে, কিন্তু চোখের ভাষা বদলায়নি। আজকের কনিয়াকরা খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে, স্কুলে যায়, কেউ কেউ গাইডের কাজ করে পর্যটকদের। তবে নিজেদের অতীত ভুলে যায়নি। গাইড হিসেবে থাকা এক যুবক তোয়াং, আমার পাশে এসে বলল:
“আমার দাদু তিনটে শত্রুর মাথা এনেছিলেন। আমি আজ ছবি তুলি, গাইডের কাজ করি, কিন্তু দাদুর গলার মালা এখনও আমাদের ঘরে টাঙানো।”
সন্ধ্যাবেলায় এক অদ্ভুৎ অভিজ্ঞতা
সেদিন সন্ধ্যায়, গ্রামের প্রতিটি ঘরের সামনে আগুন জ্বালানো হয়েছে। ঢোল, বাঁশির শব্দের মাঝে হঠাৎ এক বৃদ্ধ মাথার খুলি হাতে তুলে নাচতে শুরু করলেন। চারপাশের লোকেরা গাইতে লাগল—একটি শিকারি পুরুষের বিজয়ের গান। আমি দাঁড়িয়ে আছি—অতিথি হিসেবে, একজন সাংবাদিক হিসেবে, আবার ইতিহাসের একজন তন্ময় দর্শক হয়ে।
আমার শরীর শিউরে উঠল—এ এক সঙ্গে থাকা প্রাচীন বর্বরতা আর সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্যের।
ফিরে আসা… কিন্তু কিছু রেখে আসা
২০১৪ সালের সেই যাত্রার শেষে যখন আমি শহরের আলোকময় রাস্তায় ফিরলাম, আমার মন পড়ে রইল নাগাল্যান্ডের মেঘে ঢাকা পাহাড়ে। সেখানে জীবন যেন বয়ে চলে ইতিহাসের সঙ্গে একসাথে। আজ তারা আর মাথা শিকার করে না, কিন্তু যাদের চোখে এক সময়ে রক্ত ছিল, তাদের বংশধরের চোখে এখনো আগুন আছে।
উপসংহার: সভ্যতা মানে স্মৃতি মুছে ফেলা নয়
আমরা অনেক সময় সভ্যতা বলতে যা বুঝি, তা শুধু আলো নয়, বরং ইতিহাসের অন্ধকারকে মেনে নেওয়ার ক্ষমতা। কনিাকরা সেই অন্ধকারকে লুকোয় না। তারা বাঁচিয়ে রাখে, গর্ব করে, এবং পরিবর্তনের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে গাছের মতো—গোঁড়া প্রাচীন, ডালপালা নতুন। এই সফর আমাকে শিখিয়েছে—যা আমরা ইতিহাস বইয়ে পড়ি, তা অনেক সময় জীবন্তও হতে পারে। লংওয়ার সেই রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে, সেই পুরনো কাঠের ঘরে বসে মনে হয়েছিল—আমি যেন সময়ের চাকা ঘুরিয়ে প্রাচীন যুগে ঢুকে পড়েছি।





