১৭৫৩ সালে কলকাতার প্লেহাউস থিয়েটার ছিল ভারতের প্রথম নাট্যশালা, আর ১৭৯৫ সালে বেঙ্গলি থিয়েটার শুরু করে বাংলা নাট্য সংস্কৃতির যাত্রা।
এক রাশিয়ান নাট্যপ্রেমী ও কলকাতার প্রথম বাংলা থিয়েটার
ঐতিহাসিক কোলকাতার সন্ধ্যাকাল তখনো ধোঁয়াটে মশারির মতো ছড়িয়ে পড়েনি, চারিদিকে আলো-আঁধারির খেলা চলছে। গঙ্গার ধারে ইংরেজ চুনোপুঁটিদের ঘোড়ার টগবগ শব্দে ব্রিটিশ বসতির অভিজাত পাড়া জমজমাট হয়ে উঠছে। এমন সময়, কোথাও এক কোণে, বাংলার ভবিষ্যৎ নাট্যচর্চার ভিত গাঁথা হচ্ছে — নিঃশব্দে, নিভৃতে।
১৭৯৫ সাল। কলকাতায় এসে পৌঁছেছেন এক অদ্ভুত মানুষ — বিদেশি, রাশিয়ান, নাম গেরাসিম স্তেফানভিচ লেবেদেফ। জার শাসিত রাশিয়া থেকে এক ভাষাবিদ, সুরকার ও সংস্কৃতিপ্রেমী লোক, যিনি শুধুমাত্র ভারতীয় সংস্কৃতি ভালোবেসে এখানে এসে পৌঁছেছেন। কী অদ্ভুত আকর্ষণ! এই শহরের গন্ধ, ভাষা, শব্দ ও ছায়া যেন তাকে টেনে এনেছিল এক গভীর মোহে।
লেবেদেফ এখানে এসে প্রথমেই বাংলা ভাষা শেখেন। তবে ভাষা শেখা ছিল তার প্রকৃত উদ্দেশ্য নয় — তিনি বাংলা ভাষাকে মঞ্চে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, এমন একটি জায়গায় যেখানে তখনো নাট্যশিক্ষা ও মঞ্চচর্চা প্রায় অচেনা। কিন্তু তিনি তো ইউরোপিয়ান, অথচ ভাবনার গভীরতা ছিল বাঙালির থেকেও বেশি। নিজ খরচে কলকাতার ডোমতলা স্ট্রিটে একটি ছোট বাড়ি ভাড়া নিলেন। সেটিকেই নিজের হাতে সাজালেন নাট্যশালা হিসেবে। তৎকালীন ইউরোপীয় থিয়েটারের আদলে তৈরি করলেন গ্যালারি, সিটিং এরিয়া, প্রোসেনিয়াম আর্ক— এসব কিছু তখন বাংলার দর্শকের কাছে ছিল সম্পূর্ণ নতুন।
এই থিয়েটারের নাম দিলেন— “Bengali Theatre”। এটি ছিল বাংলা ভাষায় প্রথম নাট্যমঞ্চ। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন— বাংলা নাটকের ইতিহাস শুরু হয়েছিল এক রাশিয়ান ভদ্রলোকের হাত ধরে।
লেবেদেফের রচিত ও অনূদিত প্রথম দুটি নাটক ছিল "কাল্পনিক সংবাদ" এবং "দিশাস্তর"। এই নাটকগুলি মঞ্চস্থ হয়েছিল সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায়, বাঙালি অভিনেতাদের অভিনয়ে। সেদিনের কলকাতা অভ্যস্ত ছিল ব্রিটিশ সাহেবদের নাটক দেখতে— মূলত ইংরেজি নাটক, সুরা, আর অভিজাত দর্শকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল শহরের ‘থিয়েটার’। কিন্তু এই নাটক ছিল একেবারে অন্যরকম। না ছিল পরিশীলিত চিত্রনাট্য, না ছিল ইংরেজি আভিজাত্য— তবু তাতে ছিল আত্মার আকুতি, সংস্কৃতির মাটি ছোঁয়া প্রেম।
লেবেদেফ নিজে নাটকের নির্দেশক ছিলেন, তার বন্ধুরা ছিলেন অভিনেতা। তাঁর সংগ্রহে ছিল ইউরোপের নাট্যরীতির অভিজ্ঞতা, কিন্তু অন্তরে ছিলেন একজন ভারতপ্রেমী শিল্পী। নাটকের পর নাটক, সন্ধ্যার পর সন্ধ্যা — ধীরে ধীরে কিছু সাধারণ বাঙালি মানুষও টান পড়লো এই নতুন নাট্যচর্চায়। তাঁর স্বপ্ন যেন সফলতার দিকে এগোচ্ছিল।
কিন্তু ইতিহাস বড় নির্মম। এক রাতে, অজ্ঞাত কারণে নাট্যশালায় আগুন লেগে যায়। শোনা যায় এটি ছিল একটি ষড়যন্ত্র — সম্ভবত ব্রিটিশদেরই কারসাজি। লেবেদেফকে নিয়ে তখন নানা গুজব— তিনি কি রাশিয়ার গুপ্তচর? ইউরোপীয় হয়েও কেন তিনি ভারতীয় ভাষায় নাটক করছেন? কেন তিনি ব্রিটিশ সংস্কৃতির বাইরে চিন্তা করছেন? এই সব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সময়টুকু পাওয়া যায়নি। নাট্যশালা পুড়ে ছাই হয়ে গেল। লেবেদেফ হারালেন সবকিছু— তার মঞ্চ, তার নাটক, তার স্বপ্ন।
১৭৯৭ সালে, শেষ পর্যন্ত কলকাতা ছেড়ে তাকে চলে যেতে হয়। রাশিয়ায় ফিরে গেলেন তিনি— নিঃস্ব, অথচ ইতিহাসে থেকে গেলেন চিরকাল।
বাংলা নাটকের যে ছোট্ট অঙ্কুর তিনি বপন করেছিলেন, তার পরে ফুল ফলেছে বহুবার। স্টার থিয়েটার, মিনার্ভা থিয়েটার, বাঙালি নাট্যকারদের গৌরবময় যুগ— সবই দাঁড়িয়েছে তাঁরই রোপণ করা বীজের উপর। অথচ, আজও তাঁর নাম অনেকেই জানে না। ইতিহাসে লেবেদেফ একটি “ফুটনোট” হয়ে রয়েছেন, অথচ তাঁর কাহিনি এক মহাকাব্য।
কলকাতার নাট্যমঞ্চ আজও রক্তে বয়ে নিয়ে চলেছে সেই স্মৃতি— প্রতিটি সংলাপে, প্রতিটি মঞ্চের আলো-আঁধারিতে আজও কোথাও লুকিয়ে আছেন লেবেদেফ। একটি অচেনা মুখ, একটি আগুনে পুড়ে যাওয়া থিয়েটার, আর কিছু অমর সংলাপের প্রতিধ্বনি— এই-ই তাঁর রেখে যাওয়া ইতিহাস।
You can also read: নর মুন্ডু শিকারির দেশে
You can also read: মানুষের চামড়া দিয়ে বানানো চেয়ার-ল্যাম্প
You can also read: স্মোকি চিলি চিকেন রেসিপি


